নিজস্ব প্রতিবেদক
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সকল গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এক কোটিরও বেশি প্রবাসীদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থাসহ ৭ দফা দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে আজ ১৯ জুলাই বেলা ২টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অর্থসহ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয়।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যাদের ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময় ফ্যাসিবাদীদের পতন হয়েছে আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমরা তাদের কথা চিরদিন স্মরণ করব। তাদের কল্যাণের জন্য যা করা দরকার তাই আমরা করবো। আমরা তাদের যেন অবজ্ঞা না করি। অন্য দলকে যেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করি। আমরা রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করবো। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করব। যারা এখানে কথা বলেছেন তারা আমার মনের কথাই বলেছেন। আমাদের আর একটি লড়াই করতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে আমরা বিজয়ী হবো ইনশাআল্লাহ। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়বো ইনশাআল্লাহ। জামায়াতের এমপি প্রার্থীগণ নির্বাচিত হলে ট্যাক্স ফ্রি গাড়ী নিবে না, রাষ্ট্রীয় ফ্ল্যাট গ্রহণ করবে না। সাড়া দেশের গণহত্যা, ২৪শের গণহত্যা, পিলখানার গণহত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিচার এই বাংলার মাটিতে নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় সমাবেশে আসার সমায় পথে খুলনার দাকোপ উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আবু সাঈদ, পাবনা জেলার ঈশ্বর্দী উপজেলার মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকায় আসার পথে এবং রংপুরের শাহ আলম সমাবেশস্থলে ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমীরে জামায়াত তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন এবং তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবার- পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
আমীরে জামায়াত নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর উপর মূল্যবান বক্তব্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বক্তৃতা দানকালে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার পক্ষে বক্তব্য রাখা সম্ভব হয়নি।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনে নির্যাতিতদের সম্পর্কে, নির্যাতিত প্রবাসী ভাই-বোনদের ব্যাপারে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধনের গুরুত্ব তুলে ধরে, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের (প্রবাসী) অবদান তুলে ধরে তাদের ভোটাধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে এবং দেশবাসী ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু মূল্যবান কথা বলতে চেয়েছিলেন।
আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ ইউনুস আহমাদ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রব্বানী, এনসিপির সদস্য সচিব জনাব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের, খেলাফত আন্দোলনের আমীর আবু জাফর কাসেমী, গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি জনাব নূরুল হক নূর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, নেজামে ইসলামের মহাসচিব মুসা বিন ইযহার, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব ডা. গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি এড. একেএম আনোয়ারুল ইসলাম, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এসএম মোস্তাফিজুর রহমান, জাগপার সহসভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক, কয়েকটি শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং কয়েকজন জুলাই যোদ্ধা।
জাতীয় সমাবেশে জামায়াত বক্তব্য রাখেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মজলুম জননেতা জনাব এটিএম আজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, নায়েবে আমীর সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও সাবেক এমপি ড.এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব মোঃ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী এড. জসীম উদ্দিন সরকার, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, অন্যতম জুলাই যোদ্ধা ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কাইয়ুম।
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিমের যৌথ পরিচালনায় জাতীয় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা আবদুল হালিম, এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলাল ও মাওলানা মুহাম্মাদ শাহজাহান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান মিলন, জনাব আবদুর রব, অধ্যক্ষ মোঃ শাহাবুদ্দিন, অধ্যক্ষ মোঃ ইজ্জত উল্লাহ ও জনাব মোবারক হোসাইন প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৭ দফা দেশের জন্য মঙ্গলজনক। আমরা ৭ দফা পূর্ণভাবে সমর্থন করছি। ইসলামী ঝান্ডা নিয়ে যুবকরা এগিয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, আওয়ামী লীগ ধ্বংস, অভিসাপ, টাকা পাচার, জুলুম নির্যাতনের নাম। তারা দেশকে জঙ্গলে পরিণত করেছে। ফ্যাসিবাদীরা আবার আসলে কারো পিটের চামড়া থাকবে না, সারা বিশ্বে ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে। আমাদের একটি দল পিআর পদ্ধতি চায় না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব জনাব আখতার হোসেন বলেন, শুধু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র সুরক্ষা করা যাবে না। সুরক্ষা করতে হলে মৌলিক সংস্কার করতে হবে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চাই। পিআর যারা চায় না তারা জাতির সাথে প্রতারণা করে। মুসলমানদের ন্যুনতম অধিকার ফ্যাসিবাদীরা দেয়নি। এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক জনাব সারজিস আলম বলেন, বাংলাদেশে মুজিববাদের স্থান হবে না। খুনী হাসিনার বিচার হতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের স্থান হবে না। বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ হতে হবে। ৭২ সালের সংবিধান এক পাশে রাখতে হবে। নারী অধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার পূরণ করতে হবে। ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য, মজলুম জননেতা জনাব এটিএম আজহারুল ইসলাম বলেন, আমি ১৪ বছর জালেম সরকারের কারাগারে বন্দী ছিলাম। আমাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলো। তাই আমি বলতে চাই যে, দেশ যেমন নতুনভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তেমনি আমি নতুনভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় আমি ফাঁসির মঞ্চ থেকে লক্ষ জনতার সামনে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাকে হত্যার আয়োজন করা হয়েছিলো। আমি অন্তবর্তিকালীন সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চাই, আমাদের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে ও জেলে আটক রেখে হত্যা করা হয়েছে। যারা তাদের হত্যা করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার করতে হবে। তাদের কি অপরাধ ছিলো? তাদের অপরাধ ছিলো তারা এ দেশের জনগণের পক্ষে ও ইসলামের পক্ষে ছিলো। আজ কারা পালিয়েছে? জামায়াতে ইসলামীর কোন নেতাকর্মী পালায়নি। আমরা ৫৪ বছর বাংলাদেশ দেখলাম। কিন্তু ৫৪ বছরে বাংলাদেশের কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে কুরআনের আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করতে হবে। আমরা আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন চাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ইসলাম যেখানে থাকে সেখানে শান্তি থাকে। যেখানে ইসলামী নেই সেখানে শান্তি থাকতে পাবে না। সেখানে দুর্নীতি বাসাবাঁধে। আপনারা কি আর দুঃখ কষ্ট চলতে দিতে চান। না দিতে চাইলে সংসদে চলবে ইসলামী আইন। অন্য কোন আইন সংসদে চলবে না। শক্তি দিয়ে অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে চাই।
বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামীর নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী দেশবাসী সকলের প্রিয় দল। নারী-পুরুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের দল। জামায়াতে ইসলামী জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। দেশের জনগণের স্বার্থে জামায়াতের লড়াই অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল, সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে। জামায়াতের বৃদ্ধ নেতাদের জেলে বন্দী করে রেখে তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে। আমীরে জামায়াতের নির্দেশ জামায়াতে ইসলামী শহীদদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ঢাকা ওয়াসা-সহ সমাবেশ বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতাকারীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে। কষ্ট শিকার করে সমাবেশ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করায় ঢাকাবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে।